নামাজের সময় চোখ বন্ধ রাখলে কি ইয়াহুদীদের অনুসরণ হবে?

নামাজের সময় চোখ বন্ধ রাখলে কি ইয়াহুদীদের অনুসরণ হবে?
ছবি : সংগৃহীত। নামাজের সময় চোখ বন্ধ রাখলে কি ইয়াহুদীদের অনুসরণ হবে?।

আসসালামু আলাইকুম, নামাজের সময় চোখ বন্ধ রাখলে কি ইয়াহুদীদের অনুসরণ হবে? কেননা ইহুদীরাও ইবাদতের সময় চোখ বন্ধ করে। চলুন জেনে নেই নামাজের মধ্যে চোখ বন্ধ করা জায়েজ নাকি না-জায়েজ। সর্বপ্রথম কথা হলো, যদি কোন প্রয়োজন না থাকে তাহলে শুধু শুধু চোখ বন্ধ করাকে মাকরুহ বলা হয়েছে। মানে এমন নয় যে চোখ বন্ধ করলে নামাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নামাজ নষ্ট হবে বা নামাজ থেকে আপনার সওয়াব কমে যাবে এমন কিছু নয়। আর কিছু কিছু উলামায়ে কেরামগণ এর মতে চোখ বন্ধ করা এটা ইয়াহুদীদের আমল। কেননা ইয়াহুদীরা যখন এবাদত করে, তখন তারা চোখ বন্ধ রাখতো। এইটাকে রেফারেন্স হিসেবে নিয়ে, নামাজের সময় আপনার চোখ যদি আপনি বন্ধ রাখেন, তাহলে ইয়াহুদীদের অনুসরণ হবে এবং আপনার নামাজ নষ্ট হবে এবং এটা সুস্পষ্ট একটা ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

দেখুন ইয়াহুদিরা আল্লাহ সৃষ্টি মানুষ কিন্তু পথভ্রষ্ট। মুসলিমরা সরল সঠিক পথের উপরে আছে ব্যক্তিগত জীবনে এবং আমলের ক্ষেত্রে অনেক কিছু ইয়াহুদীদের সাদৃশ্য হতে পারে। কিন্তু এখানে মূল ফোকাসটা দিতে হবে যে, নামাজে আপনি চোখ বন্ধ করে শান্তি পাচ্ছেন নাকি চোখ খোলা রেখে শান্তি ব্যাপারগুলো নির্ভর করছে, আপনি যে স্থানে নামাজ পড়ছেন তার আশপাশের পরিস্থিতি এবং আপনার নামাজের একাগ্রতা বা মনোযোগের উপর যেটাকে আরবিতে খুশু-খুযু বলা হয়। অর্থাৎ একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ধ্যানে নামাজ আদায় করা। এটাই হওয়া উচিত মূল ফোকাস বা মূল উদ্দেশ্য। 

এখন আপনি নামাজে দাঁড়িয়ে, এমন পরিস্থিতিতে দেখা গেল যে নামাজের চারপাশে এমন অনেক কর্মকাণ্ড ঘটছে অথবা আপনার সেজদার স্থান থেকে ১০ হাত সামনে বাচ্চারা হাটাহাটি করছে। এরা কেউ খেলনা নিয়ে দুষ্টুমি করছে অথবা ডানে-বামে এমন কোন অ্যাক্টিভিটি বা কর্মকাণ্ড ঘটছে যে আপনি সেজদার স্থানের দিকে তাকিয়ে থাকার পরেও কদাচিৎ ডানে-বামে কর্মকাণ্ডের দিকে মনোযোগ কিছুটা সরে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে ওলামাগণ বলেন যে, আপনার নামাজে চোখ খোলা রাখার চেয়ে বন্ধ রাখাটাই জরুরি। কেননা যদি আপনাকে নামাজ এমন কোন স্থানে আদায় করতেই হয়, যেটা লোকালয় এবং আশপাশের কর্মকাণ্ড থেকে আপনি পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর ধ্যানে মনোনিবেশ করতে চান। এই ক্ষেত্রে আপনার জন্য চোখ খোলা রাখার চেয়ে চোখ বন্ধ রাখলে সুবিধা হয়। ওলামায়ে কেরামদের মতে সেক্ষেত্রে চোখ বন্ধ রেখে, নামাজ পড়াটাই আপনার জন্য মুস্তাহাব বা জরুরি। তাই কখনোই এমন ধারণা করা যাবে না যে, চোখ বন্ধ করা মাকরুহ বা এটা সুন্নতের বাইরে বের হয়ে যায়। 

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নামাজ গুলোর যদি আপনি তাকান, তাহলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একরাতে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে আমার নামাজ পড়ার সৌভাগ্য হলো, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা বাকারা দিয়ে নামাজ শুরু করলেন। তখন আমি ভাবলাম হয়তো তিনি ১০০ আয়াত পর্যন্ত পড়বেন তারপরে রুকুতে চলে যাবে। কিন্তু যখন তিনি পড়তেই থাকলেন পড়তেই থাকলেন, তখন আমি ভাবলাম হয়তো তিনি একটি রাকাতেই এই সম্পূর্ণ সূরা পড়ে শেষ করবেন। তারপর যখন তিনি এই পুরো আয়াতগুলো পড়ে সম্পূর্ণ সূরা পড়লেন, তখন আমি ভাবলাম হয়তো তিনি এখন রুকুতে যাবেন। কিন্তু না হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম আবার নতুন করে সূরা আল-ইমরান শুরু করলেন। সুবহানাল্লাহ তারপর সূরা আলে ইমরান সম্পূর্ণরূপে পড়ে শেষ করলেন। তারপর তিনি আবারও সূরা নিসা পড়তে শুরু করলেন। এসময় তিনি খুব শান্তি সহকারে মনমুগ্ধকর হয়ে থেমে থেমে কোরআন গুলো তেলাওয়াত করছিল। আর কিছু আয়াত পড়িয়ে বিভিন্ন তাজবি এবং তার মধ্যে তিনি দোয়াও করলেন। তারপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম রুকু করলেন। আর রুকুতে গিয়েও আল্লাহর রাসূল দীর্ঘ সময় ধরে রুকুতে স্থির হয়ে তারপর সোজা হয়ে দাঁড় তাও ঠিক ততটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন যতটা সময় তিনি রুকুর মধ্যে কাটিয়েছিলেন। তারপর তিনি সিজদাতে গেলেন, সেখানেও তিনি সূরা বাকারার সমপরিমাণ সময় সেজদাতে অতিবাহিত করলেন। সুবহানাল্লাহ! 

হযরত রাদিয়াল্লাহু তা'আলা ইরশাদ করেছেন আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নামাজে পরিপূর্ণ একাগ্রতা খুঁজে পেয়েছি। আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম দেহ মন নিয়ে পরিপূর্ণরূপে নামাজের ভিতরে প্রবেশ করে ফেলল এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নামাজ গুলো ছিল সরাসরি আল্লাহ পাকের সাথে সাক্ষাৎ তথা মেরাজের এক জলজ্যান্ত উদাহরণ। ওলামায়ে কেরামগণ বলেন, মনোযোগের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম যখন সবচেয়ে বেশি পরিমাণে উম্মতকে তাগাদা দিয়েছেন, তাই নামাজের মনোযোগের স্বার্থে সূরা গুলোকে হৃদয় হস্ত করার জন্য এবং আপনি যখন তেলাওয়াত করছেন তেলাওয়াতের ভিতরে নিজের মন মগজকে ঢুকিয়ে ফেলার জন্য চোখ বন্ধ করা পরিপূর্ণরূপে জায়েজ আছে। 

হাদিস থেকে জানা যায়, কুরাইশদের সর্দার আবু জাহেল এসে একদিন দেখল, মক্কার মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নামাজ গুলোকে মনমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিল। এরা যদিও মুশরিক কিন্তু আল্লাহর রাসূলের নামাজের একাগ্রতা দেখে এরা এতই মুগ্ধ হয়েছিল যে কয়েকশো মানুষ চারপাশে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অতঃপর আবু জাহেল দূর থেকে দৃশ্য দেখে তার গা জ্বলতে থাকে। অতঃপর সে আরো দুজন দুষ্কৃতিকারীকে আদেশ দেয় দ্রুত সিজদা রত মোহাম্মদের শরীরের উপরে মৃত উটের নাড়িভুঁড়ি গোবর সহ চাপিয়ে দাও। নাউজুবিল্লাহি মিন! নামাজের একাগ্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে, আবু জাহেলের মতো শয়তানের শরীরও জ্বলে উঠত এবং অতঃপর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম এর শরীরের উপরে তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি ভারী ওঠে নাড়িভুঁড়ি যখন চাপিয়ে দেওয়া হলো। আল্লাহর রাসূল প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু তিনি সেজদা থেকে উঠলেন না বরং নামাজের একাগ্রতায় তিনি সেজদায় পরিপূর্ণরূপে ডুবে রইলেন। সুবহানাল্লাহ! 

আমাদের নামাজগুলো এমন হওয়া উচিত, যদি আপনি আপনার বন্ধ রুমের ভেতরে নামাজ আদায় করেন, সে ক্ষেত্রে নামাজের সময় আপনার সেজদার স্থানে তাকিয়ে থাকা বা সিজদার স্থানে দৃষ্টি দেওয়া এটা শরীয়তের আমল। যদিও ওলামায়ে কেরামগণ বলছেন, যদি আপনি নামাজে চোখ বন্ধ করার মাধ্যমে বেশি মনোযোগী হতে পারেন, তবে চোখ বন্ধ করেই নামাজ পড়। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর পুরো জীবনকে রিসার্চ করলে পাওয়া যায় নামাজের মনোযোগকে আল্লাহর রাসূল সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নামাজের রাকাত সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেয়েও বরং নামাজের সৌন্দর্য একাগ্রতা খুশু-খুযু কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সহীহ বুঝ দান করুক। আমিন!